শাহজালালে রোজ উড্ডয়ন-অবতরণে বিলম্ব হচ্ছে গড়ে ৩০ মিনিট

Passenger Voice    |    ১০:৫১ এএম, ২০২৩-১০-২৩


শাহজালালে রোজ উড্ডয়ন-অবতরণে বিলম্ব হচ্ছে গড়ে ৩০ মিনিট

ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩০০ উড়োজাহাজ উড্ডয়ন ও অবতরণ করে। স্বভাবতই বিমানবন্দরটির রানওয়ে বেশির ভাগ সময়ই ব্যস্ত থাকে। ‘পিক আওয়ারে’ এ ব্যস্ততা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। রানওয়ে ফাঁকা না পাওয়ায় উড্ডয়ন বা অবতরণ করতে গিয়ে উড়োজাহাজগুলোকে অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘ সময়। আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনাকারী একাধিক বিমান সংস্থার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বর্তমানে শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে একটি ফ্লাইট উড্ডয়নের ক্ষেত্রে গড়ে ৩০ মিনিট দেরি হয়। পাশাপাশি অবতরণের সময় বিলম্ব হয় গড়ে ২০-২৫ মিনিট। রানওয়ের সক্ষমতা কম হওয়ার কারণে উড্ডয়ন বা অবতরণের ক্ষেত্রে বাড়তি এ সময় লাগছে। এতে একদিকে যেমন যাত্রীদের বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে, তেমনি এয়ারলাইনসের খরচও বহু গুণ বেড়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন তারা।

জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, ২০২৫ সাল নাগাদ শাহজালাল বিমানবন্দরে দৈনিক অবতরণ-উড্ডয়ন করা উড়োজাহাজের সংখ্যা হবে ৩৮১টি। ২০৩০ সালে তা ৪৫১টিতে উন্নীত হবে। আর ২০৩৫ সাল নাগাদ এ বিমানবন্দরে প্রতিদিন উড্ডয়ন-অবতরণ করবে ৫৪৮টি উড়োজাহাজ। ক্রমবর্ধমান যাত্রী চাহিদা মেটানোর জন্য শাহজালাল বিমানবন্দরে নতুন টার্মিনাল (টার্মিনাল-৩) নির্মাণ করছে সরকার। টার্মিনাল-৩ চালুর পর এ বিমানবন্দরে ফ্লাইটের সংখ্যা আরো বাড়বে বলে আশা করছেন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) কর্মকর্তারা।

এ পরিপ্রেক্ষিতে শাহজালাল বিমানবন্দরে উড্ডয়ন ও অবতরণের ক্ষেত্রে উড়োজাহাজগুলোর অপেক্ষা আরো দীর্ঘায়িত হওয়ার শঙ্কার কথা জানিয়েছেন আকাশ পরিবহন খাতসংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে উন্নতমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবা দিয়ে উড়োজাহাজ চলাচলের এ সমস্যা কমিয়ে আনার কাজ চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছেন বেবিচকের কর্মকর্তারা।

খাতসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে শাহজালালে উড়োজাহাজ উড্ডয়ন ও অবতরণের যে চাহিদা, তা সক্ষমতার তুলনায় কম। একটা ফ্লাইট গেট ত্যাগ করার পর থেকে ‘টেক অফ’ করা পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে বর্তমানে গড়ে ৩০-৪০ মিনিট সময় লেগে যাচ্ছে। এর বিপরীতে ‘অ্যারাইভাল কনজেশন’ও হচ্ছে গড়ে ২০-৩০ মিনিট। এতে করে ল্যান্ডিং করার আগে একটি বিমানকে অতিরিক্ত সময় আকাশে থাকতে হচ্ছে। এ ‘কনজেশনের’ জন্য একদিকে যেমন যাত্রীদের বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে, তেমনি এয়ারলাইনসের খরচও বহু গুণ বেড়ে যাচ্ছে।

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে এভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এওএবি) মহাসচিব ও বেসরকারি বিমান সংস্থা নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, ‘বর্তমানে শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে একটি ফ্লাইট ছাড়তে সর্বনিম্ন ৩০ মিনিট দেরি হচ্ছে। অবতরণের সময়ও অতিরিক্ত ২০ মিনিটের মতো সময় লাগছে। এখনই অপারেশনের সমস্যায় আছি আমরা। টার্মিনাল-৩ চালু হলে স্বাভাবিকভাবেই বিমান ওঠা-নামার সংখ্যা বাড়বে। তখন সমস্যা আরো বাড়বে। এ সমস্যার একমাত্র সমাধান নতুন একটি রানওয়ে তৈরি করা। শাহজালালে একটি বিকল্প রানওয়ে নির্মাণ করা হলে উড়োজাহাজ উড্ডয়ন-অবতরণের সময়ক্ষেপণ ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব।’

জাইকার প্রক্ষেপণে বলা হয়েছে, ২০৩০ সাল নাগাদ এ বিমানবন্দরে বছরে প্রায় দুই লাখ উড়োজাহাজ ওঠা-নামার চাহিদা তৈরি হবে। কিন্তু এ পরিমাণ উড়োজাহাজ ওঠা-নামার সক্ষমতা নেই শাহজালাল বিমানবন্দরের বিদ্যমান রানওয়ের। বাড়তি ফ্লাইটের চাহিদা পূরণে একটি বিকল্প রানওয়ে নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে বেবিচক। সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, টার্মিনাল-৩-এর কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর নতুন রানওয়ের কাজ শুরু করা হবে। তবে এটি স্বাধীন রানওয়ে হবে না। ব্যবহার করা যাবে বিকল্প রানওয়ে হিসেবে। বিকল্প রানওয়ে নির্মাণের এ উদ্যোগটি এখনো পরিকল্পনাধীন। এটি বাস্তবে রূপ দিতে কয়েক বছর সময় লেগে যাবে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

যদিও এ বিকল্প রানওয়ে ক্রমবর্ধমান ফ্লাইটের চাহিদা কতটা পূরণ করবে পারবে, তা নিয়ে সন্দিহান জিএসএ-এয়ার এশিয়া ও টাস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোরশেদুল আলম চাকলাদার। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘একটি ফ্লাইট যতক্ষণ কিউতে (উড্ডয়ন বা অবতরণের জন্য অপেক্ষা) থাকে, ততক্ষণ কিন্তু জ্বালানি বাবদ খরচ হয়। টার্মিনাল-৩ ‘প্যাক্স কিউইং’ কমাতে পারলেও ‘ফ্লাইট কিউইং’ বাড়িয়ে দিতে পারে। কারণ নতুন টার্মিনালে যাত্রীর চাহিদা বাড়বে, ফ্লাইট চলাচলও বাড়বে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান ফ্লাইটের চাপ বর্তমান রানওয়ে যেমন সামাল দিতে পারবে না, তেমনি বিকল্প রানওয়ে তৈরি করেও এ সমস্যা পুরোপুরি দূর করা যাবে না। স্বাধীন রানওয়ে গড়ে তোলা সম্ভব না হলে উড়োজাহাজ উড্ডয়ন-অবতরণের এ জটিলতা দূর হবে না।’

অন্যদিকে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান মনে করেন, ট্যাক্সিওয়ের চলমান কাজ সম্পন্নের পর এবং নতুন টার্মিনালে উন্নত গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে উড়োজাহাজ উড্ডয়ন বা অবতরণে বাড়তি সময় লাগার ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব। 

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে বিমানবন্দরে ট্যাক্সিওয়ের কিছু কাজ চলমান আছে। এ কাজের জন্য একটি বিমান অবতরণের পর সরাসরি টার্মিনালে আসতে পারে না। একটু ঘুরে আসতে হয়। ট্যাক্সিওয়ের কাজ আরো মাসখানেক চলবে। অবতরণের ক্ষেত্রে বর্তমানে যে সমস্যা হচ্ছে, আমরা আশা করছি তা দূর হয়ে যাবে। পুরোপুরিভাবে সমস্যাটি দূর করতে শাহজালালে একটি রানওয়ে নির্মাণ করা দরকার। আমরা সেই লক্ষ্যেও কার্যক্রম হাতে নিয়েছি।’

এম মফিদুর রহমান বলেন, ‘টার্মিনাল-৩ চালু হলে শাহজালালে বিমান চলাচল আরো বাড়বে। বাড়তি ফ্লাইটের চাপ সামাল দিতে পুরো ব্যবস্থাপনাটি আমরা ঢেলে সাজাচ্ছি। টার্মিনাল-৩ পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ জাপানি প্রতিষ্ঠান করবে। তাদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা হচ্ছে তারা আরো ভালোভাবে এটা হ্যান্ডেল করতে পারবে। এখন যারা করছে (গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং) তারা পুরোপুরি সেবা দিতে পারছে না। যারা পরিচালনা করছে, তাদের জনবলের স্বল্পতা আছে। ইকুইপমেন্টের স্বল্পতা আছে। তারা চেষ্টা করছে এটি বৃদ্ধির জন্য। টার্মিনাল-৩ চালুর পর জাপানি প্রতিষ্ঠান আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে বলে আমরা আশাবাদী।’

তবে উন্নত গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবা দিয়ে উড়োজাহাজ উড্ডয়ন-অবতরণের বিলম্ব দূর করা সম্ভব, বেবিচক চেয়ারম্যানের এমন মন্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং দিয়ে এয়ারপোর্ট কনজেশন দূর হবে না। ভালো গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং দিলে হয়তো যাত্রীরা দ্রুত লাগেজ পেতে পারে। কিন্তু ডিপারচার ও অ্যারাইভাল কনজেশন—এটা গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং কখনো দূর করতে পারবে না।’

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ রুট মিলে রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসসহ ৩৪টির বেশি বিমান চলাচল সংস্থা ৬০টির বেশি গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। বছরে ৯০ লাখেরও বেশি যাত্রী এ বিমানবন্দর ব্যবহার করছেন। টার্মিনাল-৩ চালুর পর শাহজালালে বছরে ১ কোটি ২০ লাখ যাত্রী সমাগমের প্রত্যাশা করছে বেবিচক। এ বাড়তি যাত্রীর জন্য প্রয়োজন হবে বাড়তি ফ্লাইট।

বেবিচকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, টার্মিনাল-৩-এর কারণে অন্তত ১৫টি বিমান সংস্থা শাহজালাল বিমানবন্দর ব্যবহারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এরই মধ্যে অনুমতির জন্য কয়েকটি বিমান সংস্থা বেবিচকে আবেদনও করেছে।  সূত্র: বণিক বার্তা


প্যা/ভ/ম